প্রতিবাদ সাধারণত সূক্ষ্ম হয় না। বাঙালি জাতি হিসেবে অহিংস আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আমাদের বেশ কম, শক্তিকে যে বিরুদ্ধ শক্তিই আটকায় এ আমাদের সংস্কারগত বিশ্বাস। সাম্প্রতিক সময়ে কলকাতায় যে প্রতিবাদের ছবি দেখা যাচ্ছে তা বর্তমান অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া এবং সম্মিলিত প্রতিরোধের প্রতীক। কারণ, ৯ অগাস্টের ঘটনা আর নয়। এখন বিচার পাওয়া যায়নি, তাই এখনও ন্যায়বিচারের দাবি জানানোর পর্ব চলছেই।
সম্মানজনক এবং সৌজন্যপূর্ণ মতবিরোধের দিনগুলো বহু আগেই গত হয়েছে। ভিন্ন রাজনৈতিক মতামতের মধ্যে সভ্য ও শালীন আলোচনার সুযোগ এখন বিরল। এই প্রতিনিয়ত বিশৃঙ্খলার মধ্যে উঠে আসা অশান্ত প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায় যে, কিছু চিকিৎসক, নারকীয় অবিচারের বিরুদ্ধে মুখর হওয়ায়, তাদের নিজেদের ক্ষমতালোভী, সুবিধাভোগী এবং অন্তঃসারশূন্য সহকর্মীদের সমালোচনা এবং বিরোধিতা হেতু প্রান্তিক অবস্থানের শিকার হচ্ছেন।
চিকিৎসকরা যে দাবি তুলছেন— অভয়ার বিচার ও সুরক্ষিত পরিকাঠামো —তা তো তাঁদের প্রাপ্য। শুধু তাদের নয় সমস্ত জনগণেরই ন্যায্য বিচার ও সুরক্ষা প্রাপ্য। গত মাসে, প্রত্যেক চিন্তাশীল ও সংবেদনশীল মানুষের জন্য এক মাসের শোক, অবিশ্বাস, ন্যায়ের পক্ষ নেওয়ার এবং একই সঙ্গে হতাশার সময়। এমনকী চিকিৎসকদের ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোকে নৈতিকভাবে ক্ষতির সমতুল্য মনে করা হচ্ছে।
৯ অগাস্ট, ২০২৪ কলঙ্কনিন্দিত তারিখ, আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে নারীরা এখনও তাদের কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষিত নয়। যখন আমরা সারা বিশ্বের সহকর্মী এবং বন্ধুদের কাছ থেকে তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হই, তখন আমরা কেবল একটি ন্যায়সংগত সমাধানের জন্য প্রার্থনা করতে পারি।
৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪-এ, চিকিৎসকরা, তাঁদের পরিবার এবং সমর্থকেরা বিশ্বের বিভিন্ন শহরে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে একত্রিত হয়েছিলেন, একটিমাত্র প্রার্থনা নিয়ে! আরজি করের নিন্দনীয় নৃশংসতার ন্যায়বিচার। এই আন্দোলন, যা পুরো মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা এবং অবহেলার বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের প্রতিচ্ছবি, জনরোষ এবং ঘটনার এক মাস পেরিয়ে গেলেও তদন্তের ধীর গতি কেবল ক্রোধকে আরও উস্কে দিয়েছে, যার ফলে এই বৈশ্বিক প্রতিবাদগুলো হচ্ছে।
সময়ের মধ্যে ন্যায়বিচার দিতে ব্যর্থ হওয়া আমাদের জাতির এক বড় দুর্বলতা হিসেবে রয়ে গিয়েছে। এই বৈশ্বিক অংশগ্রহণ এই সংগ্রামের সার্বজনীন প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করে, যেখানে পৃথিবীর প্রতিটি কোণে স্বাস্থ্যকর্মীরা একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন—অর্থায়নের অভাব, অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং নিরাপত্তার অভাব। এই প্রতিবাদগুলি এক শক্তিশালী স্মারক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এক কোণে আবহমান ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই শুধু সেখানে সীমাবদ্ধ নয়; এটি আরও বহু দূরে ছড়িয়ে পড়েছে, সম্মিলিত লক্ষ্য এবং সম্মান, মর্যাদা ও সুরক্ষার দাবিতে চিকিৎসকদের ঐক্যবদ্ধ করেছে।
এই ব্যাপক গণআন্দোলনে, জনসাধারণ তাদের সমর্থন দিয়ে কেবল নীরব দর্শক হয়নি; তারা পদ্ধতিগত পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে উঠেছে, চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়িয়ে ন্যায়সঙ্গত সংস্কার দাবি করেছে, যা তাদের জীবন রক্ষায় নিবেদিতদের সুরক্ষা দেবে। আর্থসামাজিক বিভেদ বিস্মৃত এই আন্দোলন কেবল চিকিৎসা সম্প্রদায়ের মনোবলকেই উজ্জীবিত করেনি বরং এমন এক সম্মিলিত ন্যায়বিচারের দাবি গড়ে তুলেছে যা সীমান্ত এবং পেশার গণ্ডি অতিক্রম করেছে।
এখন সারা বিশ্বের ভারতীয়রা সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিদের সঠিক রায়ের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আর এই আন্দোলনে তো কোনও আধিপত্য স্থাপনার অভিলাষ নেই—শুধু আছে অবিচলিত প্রতিরোধের ভার। আর এখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের অটুট মনোবল এবং অসীম সাহসিকতার সঙ্গে, অন্যায়ে এক দুর্বিনীত, সর্বগ্রাসী, অলঙ্ঘনীয় উপস্থিতির সামনে।
শুধু একটাই দাবি বিচার চাই…